
স্বস্তির বাহন মেট্রোরেলে বাড়ছে যাত্রী অসন্তোষ
- আপলোড সময় : ০৯-০৪-২০২৫ ০৪:৫৭:৫৫ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৯-০৪-২০২৫ ০৪:৫৭:৫৫ অপরাহ্ন


* ১৬টি স্টেশনের অকার্যকর টিকিট কাটার ভেন্ডিং মেশিন ২২টি
* স্বয়ংক্রিয় পাঞ্চিং মেশিনের সমস্যা
* কামরা ও ট্রেন চলাচলের সময় বৃদ্ধি
রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালুতে যাতায়াতে সাধারণ মানুষের মাঝে নেমে এসেছিল স্বস্তি। কিন্তু এই স্বস্তির মাঝে নানা বিড়ম্বনায় যাত্রীদের মধ্যে ক্রমেই বাড়ছে অস্বস্তি। ভেন্ডিং মেশিন নষ্ট, একক যাত্রার টিকিটের সংকট, যান্ত্রিক কিংবা বৈদ্যুতিক ত্রুটিতে রেল বন্ধ, পকেটমারের উৎপাত, যৌন হয়রানি, স্টাফদের খারাপ আচরণসহ নানাবিধ সমস্যায় বেড়ে চলেছে যাত্রী অসন্তোষ।
মতিঝিল থেকে উত্তরাগামী মেট্রোরেলে যাতায়াতকালে এক নারী ও তার শিশুকন্যা গত ৫ মার্চ যৌন হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার দিন-ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘটনা তুলে ধরেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা নিলুফার পারভিন। পেশায় চিকিৎসক নিলুফার পারভিন জানান, মেট্রোরেলে নারীদের জন্য সংরক্ষিত একমাত্র বগিতে ১০-১২ জন পুরুষ উঠে পড়ে। তাদেরই কারও দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ফার্মগেট স্টেশন ছাড়ার পর কাঁদতে কাঁদতে ওই নারী তার শিশুকন্যাকে নিয়ে গেটের কাছে এসে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেন। আবার ৬ মার্চ মতিঝিল স্টেশনে মেজবা উদ্দিন নামে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এক কর্মকর্তার পকেট থেকে ২৫ হাজার কানাডিয়ান ডলার খোয়া যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এর আগে গত ২ জানুয়ারি নাঈম ইসলাম সোহাগ নামে এক যাত্রী পকেটমার থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পাওয়ার বিবরণ লেখেন ‘মেট্রোরেল প্যাসেঞ্জার কমিউনিটি’ নামে একটি ফেসবুক পেজে।
সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াতের বাহন মেট্রোরেল ক্রমেই যেন অনিরাপদ হয়ে উঠছে। মেট্রোতে যাতায়াতকালে মাঝেমধ্যেই ঘটছে পকেটমার, যৌন হয়রানিসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এরই মধ্যে পকেটমার থেকে সাবধানে থাকার পরামর্শ ও সতর্কবার্তা দিচ্ছে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ। তবে এসব ঘটনা বন্ধে মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো জানা যায়নি। এ ছাড়া শাহবাগসহ মেট্রোরেলের বিভিন্ন স্টেশনের ভেন্ডিং মেশিন মাঝেমধ্যেই নষ্ট থাকে। ফলে স্টেশনের টিকিট অফিস মেশিনে (টিওএম) যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন থাকে। তবে যাদের কাছে এমআরটি পাস রয়েছে, তারা নির্দ্বিধায় স্টেশনে ঢুকে রেলে যাতায়াত করছেন। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টা, মিরপুর-১০ মেট্রোরেল স্টেশনের টিকিট ভেন্ডিং মেশিনের সামনে বেশ কিছু লোকজন। উত্তর পাশের তিনটি ভেন্ডিং মেশিন থাকলেও চলমান রয়েছে একটি। ভেন্ডিং মেশিনের দু’টি বুথ বন্ধ থাকায় একটা মেশিনের সামনে সবাইকে দাঁড়াতে হচ্ছে। এটি শুধু মিরপুর-১০ মেট্রো স্টেশনের চিত্র নয়। উত্তরা উত্তর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনের প্রায় একই চিত্র। প্রতিটি স্টেশনে গড়ে ১ থেকে ২টি করে টিকিট কাটার ভেন্ডিং মেশিন বড় একটা সময় অকার্যকর হয়ে পড়ে থাকে। এছাড়া ভেন্ডিং মেশিনে ভাঙতি টাকার সমস্যা, নতুন এমআরটি পাশ বন্ধ থাকা, একক যাত্রার টিকিট সংকট ও স্বয়ংক্রিয় পাঞ্চ মেশিনেও মাঝেমধ্যেই ঝামেলা হয়। এসব কারণে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে নিয়মিত মেট্রোরেলে চলাচলকারী যাত্রীরা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, যান্ত্রিক ব্যাপারে মাঝেমধ্যে নানা কারণে ত্রুটি দেখা দিতে পারে এবং সেটি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করেন তারা। যাত্রীরা জানান, অফিস টাইমে যখন যাত্রীদের চাপ থাকে তখন বিভিন্ন স্টেশনের টিকিট কাটার ভেন্ডিং মেশিন অকার্যকর হয়ে থাকে। দীর্ঘ সময়েও সচল হয় না। অনেক সময় ভাঙতি টাকা না থাকায় টিকিট কাটা সম্ভব হয় না। এছাড়া স্টেশন থেকে বের হওয়ার ডিজিটাল পাঞ্চ মেশিন মাঝে মাঝে-ই অকার্যকর হয়ে যায়। তখন স্টেশন থেকে বের হতে দেরি হয়। অন্যদিকে নতুন এমআরটি ও র?্যাপিড পাশ না থাকায় নিয়মিত চলাচলকারীদের একক টিকিট কাটতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। যাত্রীদের দাবি, মেট্রোরেল অন্তত রাত ১১টা পর্যন্ত চালু রাখতে হবে। নারীদেরসহ আরও কামরা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া এমআরটি ও র্যাপিড টপআপ সুবিধা মোবাইল ব্যাংকিং’র মাধ্যমে করার দাবিও জানান অনেকে।
সরেজমিনে বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, মেট্রো স্টেশনের মতিঝিল স্টেশনের ৬টি টিকিট কাটার ভেন্ডিং মেশিনের মধ্যে সচল ৫টি, বাংলাদেশ সচিবালয়ের ৬টি মেশিনের মধ্যে ৪টি সচল, শাহবাগ স্টেশনের ৬টির মধ্যে ৫টি সচল, উত্তরা সেন্টারের ৪টি মেশিনের মধ্যে ২টি সচল, মিরপুর-১১ স্টেশনের ৪টি মেশিনের মধ্যে ৩টি সচল, উত্তরা উত্তরের ৬টি মেশিনের মধ্যে ৫টি সচল। এছাড়া টিএসসি, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, বিজয় সরণী, আগাঁরগাও, শেওড়াপারা, কাজীপাড়া স্টেশনের গড়ে ১-২টি করে ভেন্ডিং মেশিন অকার্যকর হয়ে থাকে বেশিরভাগ সময়।
১৬টি স্টেশনের অকার্যকর টিকিট কাটার ভেন্ডিং মেশিন ২২টি: ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) উত্তরা থেকে মতিঝিল রুটের ১৬টি মেট্রো স্টেশনে প্রায় ২২টি টিকিট কাটার ভেন্ডিং মেশিন অকার্যকর থাকে বেশিরভাগ সময়। এতে যাত্রীদের চাপে টিকিট কাটার লাইন যেমন দীর্ঘ হয়; তেমনি ভোগান্তিও পোহায় তারা। কারওয়ান বাজারে নিয়মিত অফিস করেন আব্দুল্লাহ মামুন। তিনি বলেন, মেট্রোরেলের অন্যতম ব্যস্ত স্টেশন হলো কারওয়ান বাজার। কিন্তু এখানকার মোট ৬টি ভেন্ডিং মেশিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময় ১-২টি মেশিন কাজ করে না। ফলে অন্য মেশিনের ওপর চাপ পড়ে এবং টিকিট কাটার লাইন দীর্ঘ হয়। এই ব্যাপারে কল বাটনে চাপলে অথবা স্টেশনে কর্তৃপক্ষের কোনো ব্যক্তির কাছে অসুবিধার ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা উত্তর দিতে পারেন না। এই ভোগান্তির সমাধান চাই। মিরপুর থেকে নিয়মিত মতিঝিলে অফিস করেন আলতাফ হোসেন। তিনি বলেন, মিরপুর-১০ স্টেশনের যাত্রীর চাপ সব সময়ই থাকে। তবে এখানে টিকিট কাটার সময় দেখা যায় ভেন্ডিং মেশিন কোনো একটা অকার্যকর হয়ে আছে। আবার অনেক সময় টাকার নোট নিয়ে আর টিকিট বের হচ্ছে না।
এ বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পরিচালক এ কে এম খায়রুল আলম বলেন, ভেন্ডিং মেশিন হলো যান্ত্রিক একটি ব্যাপার নানা কারণে বিভিন্ন সময় ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তবে সেটি দ্রুত সমাধানের জন্য আমাদের লোকবল আছে এবং তারা নিয়মিত কাজ করে।
স্বয়ংক্রিয় পাঞ্চিং মেশিনের সমস্যা: মেট্রোর টিকিটের মাধ্যমে সবাই স্বয়ংক্রিয় পাঞ্চিং মেশিন দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করেন। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পর বের হওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয় গেটে ভিড় লেগেই থাকে। তবে এই গেটে দ্রুত টিকিট পাঞ্চ ও বিভিন্ন ত্রুটির কারণে হুট করেই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এতে যাত্রীদের স্টেশন থেকে বের হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। রানা ইসলাম নামের একজন যাত্রী বলেন, নিয়মিত আমি এমআরটি পাশ ব্যবহার করে মেট্রোতে চলাচল করি। কিন্তু মাঝে মাঝে স্বয়ংক্রিয় গেট অকার্যকর হয়ে যায়। অনেক সময় যাত্রীদের দ্রুত বের হওয়ার তাড়ায় টিকিট পাঞ্চ করতে একটু ত্রুটি হলে এটি বেশি হয়। কিন্তু ট্রেন থেকে নামার পর গেটে প্রচুর চাপ থাকে ফলে এমন ত্রুটি দেখা দিলে সবার-ই ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
কামরা ও ট্রেন চলাচলের সময় বৃদ্ধি: দীর্ঘদিন থেকে এমআরটি ও র?্যাপিড পাশ বন্ধ থাকলেও গত দু’দিন থেকে এটি চালু হয়েছে। অন্যদিকে যানজটের নগরীতে স্বস্তির বাহন মেট্রোরেলে সব সময় ভিড় থাকেই। ফলে কামরা বৃদ্ধি ও রাত ১১টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল করলে সবার জন্য সুবিধা হয় বলে জানান অনেকে।
রেজাউল করিম নামের এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী বলেন, আমার এমআরটি পাশ হারিয়ে গেছে কিছুদিন আগে। নতুন করে এই পাশ চালু না থাকায় প্রতিদিন টিকিট কেটে শেওড়াপাড়া থেকে মতিঝিল যেতে হয়। এতে মাঝে মাঝেই ভাঙতি টাকা, একক যাত্রার টিকিট সংকট ও দীর্ঘ লাইনসহ নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফরিন জাহান উত্তরায় থাকেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামের কারণে অনেক দিন দেরি হয়। কিন্তু রাত ১০টার পর আর মেট্রো চলাচল করে না। ঢাকার মধ্যে মেট্রোরেল-ই একমাত্র নারীদের নিরাপদ বাহন। সেই হিসেবে মেট্রোরেলের কামরা বৃদ্ধি ও চলাচলের সময় আরও একটু বৃদ্ধি করলে সবার জন্য সুবিধা হয়। তিনি আরও বলেন, এমআরটি পাশের টাকা টপআপ করতে হয় স্টেশনে এসে। কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে টপআপ সুবিধা দিলে সবার জন্য ভালো এবং স্টেশনের চাপ কম হবে।
সার্বিক বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) পরিচালক এ কে এম খায়রুল আলম বলেন, যারা নিয়মিত মেট্রোরেলে চলাচল করেন তাদের টিকিট কাটার সময় কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে যারা ঢাকায় ঘুরতে আসেন বা প্রথম টিকিট কাটেন তারা অনেক সময় মেশিন ভুলভাবে ব্যবহার বা ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের ফলে ভেন্ডিং মেশিনে সমস্যা হয়। তবে এসব দেখার জন্য আমাদের লোকবল আছে, বেশি সময় যাত্রীদের ভোগান্তি হওয়ার কথা নয়। র?্যাপিড পাশ ও একক টিকিটের সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, গত দু’দিন থেকে র্যাপিড পাশ চালু হয়েছে। আর একক যাত্রার টিকিট সংকটেরও সমাধান হয়ে গেছে। আশা করি আর কেউ এসব ব্যাপারে ভোগান্তিতে পড়বেন না। তিনি বলেন, হুট করেই ট্রেনের কামরা বাড়ানো সম্ভব নয়। এটি সময়সাপেক্ষ একটি ব্যাপার। কারণ সেটি পরিচালনার জন্য নতুন জনবল প্রয়োজন।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ